বুলিং কী এবং কেন এটি ক্ষতিকর?
জাতীয় শিক্ষা পরিসংখ্যান কেন্দ্রের (২০১৩) তথ্য অনুযায়ী, ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ২২ শতাংশ স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশেও বুলিং একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হয়।
বুলিং হলো ইচ্ছাকৃতভাবে শারীরিক, মৌখিক বা মানসিকভাবে কারো ক্ষতি করা। শারীরিক বুলিংয়ের মধ্যে মারধর এবং ধাক্কা দেওয়া অন্তর্ভুক্ত, মৌখিক বুলিংয়ের মধ্যে ব্যাঙ্গাত্মক নাম ধরে ডাকা, উপহাস করা এবং মানসিক বুলিংয়ের মধ্যে রয়েছে ভয় দেখানো, উপহাস করা এবং গুজব ছড়ানো অন্তর্ভুক্ত। বুলিং শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, স্ব-সম্মান এবং মনোবলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বুলিংয়ের লক্ষণগুলো কী কী?
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা প্রায়ই বুঝতে পারি না যে আমাদের সন্তানেরা বুলিং শিকার হচ্ছে । তবে, যদি আপনি খেয়াল করেন তাহলে বুঝতে পারবেন আমাদের সন্তানেরা বুলিংর শিকার হচ্ছে কিনা:
– বাচ্চারা উদ্বিগ্ন থাকে তারা ঠিক মতো লেখাপড়া করতে চায় না ইভেন তারা স্কুলে যেতে চায় না।
– খাওয়া এবং ঘুমের অভ্যাসের ব্যাঘাত ঘটায়।
– তার রুটিন ওয়ার্ক এ ব্যাঘাত ঘটায়।
– সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষ এবং পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চায়।
বুলিং রোধে করণীয়:
বুলিং নিয়ে আলোচনা:
বুলিং নিয়ে কোন আলোচনা করার জন্য টিভিতে কোন প্রতিবেদন বা কার্টুন দেখিয়ে বুলিং সম্পর্কে সচেতন করুন; তারপর নিচের প্রশ্নগুলোর সন্তানকে করুন :
– “তুমি এ বিষয়ে কী ভাবছো?”
– “তুমি কি কখনও স্কুলে কাউকে বুলিং হতে দেখেছো?”
– “ওটা কেমন ছিল?”
– “তুমি কি ভাবো যে ওই ব্যক্তি কী এটা ঠিক করেছে এবং সে কি করতে পারত?”
শিশুদের কী করতে হবে শেখান:
শিশুদের জিজ্ঞাসা করুন তারা বুলিংয়ের শিকার হলে বা অন্য কাউকে বুলিং হতে দেখলে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে। শিশুদের উৎসাহিত করুন যদি তারা বুলিং হতে দেখে বা বুলিংয়ের শিকার হয় তবে যেন তারা কোনো প্রাপ্তবয়স্ককে জানায়।
শোনা:
আপনার সন্তানের সাথে প্রতিদিন আলোচনা করুন তার সারাটা দিন কেমন কাটলো। স্কুল থেকে ফেরার পর জানার চেষ্টা করুন ফুলের সময় টা কেমন কাটলো তার। তার গল্প থেকে শব্দ খেয়াল করার মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন আজকে সে বুলিং এর শিকার হয়েছে কিনা।
সহানুভূতিশীল হওয়া:
অনেক সময় শিশুরা আমাদের কাছ থেকে আসল ঘটনা লুকাতে চায় কারন তারা মনে করে সে যে বুলিং এর শিকার হয়েছে এটা তার দোষের কারণে। এক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হতে হবে তার সন্তানের প্রতি। তানা তানাহলে সে ভবিষ্যতে আপনাকে আর আসল ঘটনা বলবে না।
উৎসাহ:
শিশুদের সাথে ওপেন ডিসকাশন করুন; এবং তথ্য শেয়ার করার জন্য তার প্রশংসা করুন।
শিশুদের উন্মুক্ত এবং এই তথ্য শেয়ার করার জন্য প্রশংসা করুন। তাদের মনে করিয়ে দিন যে বুলিং আচরণটি বুলির সাথে আরও সম্পর্কিত, তাদের সাথে নয়। বলবেন না “শক্ত থাকো।” বলুন, “ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। সাহস হলো তোমার ভয় মোকাবেলা করা।”
সমস্যা সমাধান:
আপনার শিশুকে নিরাপদে বোধ করতে সহায়তা করার জন্য আপনি কী করতে পারেন তা নিয়ে আলোচনা করুন। আপনার শিশু নির্ধারণ করুন যে তারা কি শিক্ষককে পরিস্থিতি জানাতে চায়, না আপনি স্কুলে এসে শিক্ষককে জানানোর সহায়তা করবেন। শিশুদের শিক্ষক বা প্রশাসকের সাথে কথা বলার জন্য উৎসাহিত করা তাদের ক্ষমতায়ন করে এবং নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ফিরিয়ে দেয়।
ক্ষমতায়ন:
শিশুদের বুলিং মোকাবেলা করার জন্য সরঞ্জাম দেওয়া তাদের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেবে এবং তাদের শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দিতে সক্ষম করবে। উদাহরণস্বরূপ: বুলিকে এড়ানো এবং স্কুলে বন্ধু ব্যবস্থা ব্যবহার করা; রাগ হলে দূরে সরে যাওয়া এবং আত্মশান্তির কৌশলগুলি অনুশীলন করা; সাহসী আচরণ করা এবং বুলিকে উপেক্ষা করা; সামাজিক মাধ্যম এবং টেক্সটিং থেকে বুলিকে ব্লক করা; এবং প্রাপ্তবয়স্কের সাহায্য চাওয়া।
আপনি কী করবেন তা নির্ধারণ করুন:
বুলিংয়ের প্রভাব আপনার শিশুদের শিখন ও সামাজিক পরিবেশে কেমন প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে আপনার শিশুদের সাথে নিয়মিত চেক ইন করুন। সমস্যাটি কার্যকরভাবে সমাধান না হলে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান কী হবে তা মূল্যায়ন করুন এবং নির্ধারণ করুন। কখনও কখনও পরিবেশ পরিবর্তন করা বুলিং অভিজ্ঞতা দূর করার একমাত্র উপায় হতে পারে।
বয়সভিত্তিক বুলিং প্রতিরোধের পরিকল্পনা
৫-৭ বছর
কৌতূহল প্রশ্ন : টিভি শো বা গল্পের মাধ্যমে বুলিং নিয়ে আলোচনা শুরু করুন।
শিক্ষা : শিশুদের শিখান কিভাবে বুলিং থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হয় এবং কিভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জানাতে হয়।
শোনা : শিশুদের কথা শুনুন এবং তাদের সান্ত্বনা দিন।
প্রতিক্রিয়া : বুলিং হলে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা শেখান।
৮-১০ বছর
কৌতূহল প্রশ্ন : স্কুলে বুলিং সম্পর্কে তাদের চিন্তা জানতে চাওয়া।
শিক্ষা : বুলিং হলে কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা শেখান এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জানাতে উৎসাহিত করুন।
শোনা : তাদের অভিজ্ঞতা শুনুন এবং সমর্থন দিন।
প্রতিক্রিয়া : পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কৌশল শিখান।
১১-১৩ বছর
কৌতূহল প্রশ্ন : তাদের স্কুল অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানুন।
শিক্ষা : তাদের নিজেদের সুরক্ষা এবং বুলিংয়ের শিকার হলে কী করতে হবে তা শেখান।
শোনা : তাদের কথা শুনুন এবং সমর্থন দিন।
প্রতিক্রিয়া : পরিস্থিতি সমাধানে সাহায্য করুন।
বাংলা মাধ্যম এর চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে উভয় ক্ষেত্রেই এই ব্যপারটা পরিলক্ষিত হয়
১৪-১৮ বছর
কৌতূহল প্রশ্ন : স্কুলে বুলিং নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করুন।
শিক্ষা : বুলিং মোকাবেলা করার কৌশল শিখান এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জানাতে উৎসাহিত করুন।
শোনা : তাদের কথা শুনুন এবং সমর্থন দিন।
প্রতিক্রিয়া : পরিস্থিতি সমাধানে তাদের সঙ্গে আলোচনা করুন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন।
সাইবার বুলিং থেকে সুরক্ষার উপায় (শিশুদের জন্য):
- নিজের ছবি বা তথ্য অপরিচিতদের সাথে শেয়ার করবে না।
- তোমার সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইল প্রাইভেট রাখো।
- কেউ খারাপ মন্তব্য করলে সেটির স্ক্রিনশট নিয়ে মায়ের বা বাবার সাথে কথা বলো।
- খারাপ মেসেজ পেলে সেই ব্যক্তিকে ব্লক করে দাও এবং রিপোর্ট করো।
- সবসময় ভালো চিন্তা করো এবং খারাপ কথায় মন খারাপ করো না।
উপসংহার
বুলিং মোকাবেলা করা একটি কঠিন কাজ হতে পারে, তবে সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে পিতামাতারা তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। বাংলাদেশে বুলিংয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। আপনার যে কোন সাজেশন নেয়া হবে
Sources:
- “Wonder” by R.J. Palacio
- “The Juice Box Bully: Empowering Kids to Stand Up for Others” by Bob Sornson and Maria Dismondy
- “Stand Tall, Molly Lou Melon” by Patty Lovell
- Cyberbullying and Preventive Measures: Bangladesh in Context